প্রিয় পাঠক,
কেমন আছেন? আশা করি ভাল । আমি ২১ জুন ২০২০ YouTube এর ফিডে প্রথম দেখি লিভিং ঈগল সাইফুল আজম এর নাম। এরপর পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এর YouTube official Channel এর একটা ভিডিও দেখলাম । আমি কয়েকটি সোর্স দেখে বুঝলাম সাইফুল আজম একজন অসাধারন মানুষ ।
বীর বৈমানিক সাইফুল আজম: এক কিংবদন্তির জীবনী
সাইফুল আজম (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ – ১৪ জুন ২০২০) ছিলেন এক বীর বাংলাদেশি আকাশযোদ্ধা, যিনি চারটি দেশের বিমানবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাস গড়েছেন। পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালের দুইটি ঐতিহাসিক যুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সর্বাধিক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার একক রেকর্ড আজও তারই দখলে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সাইফুল আজম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, পাবনা জেলার খলিশাদহ-খাগড়বাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা নুরুল আমিনের কর্মসূত্রে শৈশব কেটেছে কলকাতায়। দেশভাগের পর পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মজীবন (১৯৬০–১৯৭১)
যুক্তরাষ্ট্রের লুক এয়ার ফোর্স বেস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি “টপ গান” উপাধি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের পক্ষে অংশ নেন এবং একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেন। এতে তিনি পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার সিতারা-ই-জুরাত লাভ করেন।
পরবর্তীতে তিনি জর্দানের রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্সে উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে জর্দান ও ইরাকের পক্ষে লড়ে তিনি একাই চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেন—যা একটি বিশ্বরেকর্ড।
এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি জর্দানের অর্ডার অব ইস্তিকলাল এবং ইরাকের নুত-আল-শুজাত পদক অর্জন করেন।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে অবদান (১৯৭১–১৯৭৯)
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকারের সন্দেহভাজন হিসেবে তিনি বন্দিত্ব ও নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার এবং পরবর্তীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক এবং ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি অবসর নেন।
বেসামরিক ও রাজনৈতিক জীবন
সাইফুল আজম ১৯৮২–৮৪ ও ১৯৮৭–৮৮ সালে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (CAAB) চেয়ারম্যান ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (FDC) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন।
রাজনৈতিকভাবে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং পাবনা-৩ আসন থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার
তাঁর স্ত্রী নিশাত আজম ছিলেন একজন আইনজীবী। তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাক্তন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম তাঁর চাচাতো ভাই ছিলেন।
সম্মাননা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৬৫: সিতারা-ই-জুরাত, পাকিস্তান
১৯৬৭: অর্ডার অব ইস্তিকলাল, জর্দান
১৯৬৭: নুত-আল-শুজাত, ইরাক
২০০১: লিভিং ঈগল উপাধিতে ভূষিত, মার্কিন বিমানবাহিনী
২০১২: সর্বাধিক ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত বৈমানিক হিসেবে স্বীকৃতি
বিশ্বের আটটি দেশের বিমানবাহিনী তার প্রশিক্ষণ দক্ষতা এবং নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে—যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও চীন।
মৃত্যু ও শ্রদ্ধা
২০২০ সালের ১৪ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৫ জুন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বাশার ঘাঁটিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা শেষে শাহীন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
ফিলিস্তিনের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকরা তার অবদানের প্রশংসা করে বলেন, “তিনি ছিলেন আল-আকসা রক্ষার প্রকৃত যোদ্ধা” এবং “আকাশের ঈগল”।
উপসংহার
সাইফুল আজম ছিলেন সাহস, দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বোধের প্রতীক। তার জীবন ইতিহাসে বিরল এক অনন্য অধ্যায়—যেখানে সীমান্ত পেরিয়ে যুদ্ধ করেছেন মানবতার পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি আজও বাঙালির গর্ব, বিশ্ব আকাশযুদ্ধের কিংবদন্তি।
Resource: